Saturday 15 September, 2012

কাগজের ফুল



আর মাত্র দুই ঘন্টা বাকি।প্রতি বছর এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নৈরিতা।হ্যা,আজ একজনের জন্মদিন।ওর নিজের না,আজ অনিকের জন্মদিন।গত দুই বছর ধরে ও সবকিছু থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়,কিন্তু শুধু এই একটা দিন ব্যতিক্রম,এই দিনটার জন্য বছরের ৩৬৪টা দিন ধরে অপেক্ষায় থাকে ও। আজও যেমন এই ভিনদেশে,ওর রুমের সাথে লাগোয়া ছোট বারান্দাটায় বসে আছে। যথারীতি ঘর অন্ধকার।পাশের ঘরে অবশ্য আলো জ্বলছে।ওই আলোতেই একটা আলো আধারী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাশের রুমে মার্গারেট ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলছে।সেও জানে আজ নৈরিতার কান্না রাত।
সারা বছর ও একদম স্বাভাবিক থাকে।সবাই জানে খুব গুছানো আর হাসি খুশি মেয়ে নৈরিতা।কিন্তু এই একটা দিন ও কারো সাথেই কথা বলেনা। বারান্দায় একটা ছোট টেবিলে ১টা চকলেট কেক,এক গুচ্ছ লাল গোলাপ,আর একটা কাগজ নিয়ে বসে চুপ করে কাঁদে।হাসিখুশি মেয়েটা এই দিনটাতে কেন এত কাঁদে মার্গারেট অনেক জিজ্ঞেস করে আজও তার উত্তর পায়নি।তাই এখন আর ওকে এটা নিয়ে ঘাটায় না ও।
প্যাকেটটা থেকে কেকটা বের করে টেবিলে রাখে নৈরিতা।অনিকের প্রিয় চকলেট কেক।একটা বড় মোমবাতি জ্বালায়। মোমের আলোটা অনেক মিষ্টি লাগে ওর,যেমন লাগত অনিকের কাছে।পাগলটা প্রায়ই বলত ও নাকি বিয়ের পর রাতের বেলা লাইট অফ করে শুধু মোমবাতির আলোয় ডিনার করবে! সেই মোলায়েম আলোতে মেঝেতে বসে লিখতে শুরু করে চিঠিটা।এই যান্ত্রিক যুগে এখন আর কাউকে চিঠি লেখা হয়না সারা বছর,শুধু এই দিনে একটা চিঠি লিখে ও।ফিরে যায় পুরানো দিনগুলোতে।
অনিক।খুব চুপচাপ গোছের ছেলে।নৈরিতাও তাই।সবার সাথেই মেশে,কিন্তু নিজের কথা নিজের মধ্যে আড়াল করে রাখতে পছন্দ করে দুজনই। ভার্সিটির প্রথম দিনই দুজনের পরিচয়। সেই ক্লাসমেটের সম্পর্ক আস্তে আস্তে বন্ধুত্বে গড়ায়। একসময় দুজনই দুজনার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যায়।প্রতিদিন একসাথে ক্লাস,আড্ডা,পড়াশুনা।দুজনেই গানের পাগল।কানে সবসময় হেডফোন থাকবেই। কোন একটা গান একজনের ভাল লাগলে সবার প্রথমে আরেকজনকে শুনানো চাই।আর নিজেদের একান্ত কথাগুলো,পাওয়া না পাওয়া,আশা,হতাশাগুলো নিজেদের সাথে শেয়ার করা।নৈরিতা খুব ভাল রবীন্দ্রসংগীত গায়।সারা জীবন রক,মেটাল,হিন্দি গান শুনে বেড়ে ওঠা অনিক মুগ্ধ হয়ে শুনে আর বলে আর কয়টা দিন অপেক্ষা কর,গিটার বাজানো শিখছি।এরপর একদিন শীতের রাতে,তারাভরা আকাশের নিচে,তুই গান করবি গলা ছেড়ে আর আমার হাতে থাকবে গিটার।সামনে থাকবে এক পেয়ালা চা। এভাবেই কখন যে ওরা একে অন্যের হয়ে যায় টেরই পায় নি। নৈরিতা প্রথমে মেনে নিত না,ভাবত হয়ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি,এটা ভালবাসা নয়।কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারে,এটাই ভালবাসা।অনিক যখন ছুটিতে বাড়ি যেত,বা কোথাও ঘুরতে যেত,সেই অল্প সময়টুকুই যথেষ্ট ছিল অনুভূতিটূকু বুঝার জন্য,কোথায় যেন একটা শুন্যতা নেমে আসত নৈরিতার জগতে,কি যেন নেই,কি যেন নেই।ওদিকে নৈরিতাও বুঝতে পারে অনিকের মনেও চলছে একই রকম যুদ্ধ।ওদের মাঝে কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি বন্ধুত্ব থেকে একটু বেশি? একসময় মেনে নেয় নৈরিতা,নিজের সাথে যুদ্ধ করা থামিয়ে শুরু করে অপেক্ষা।অপেক্ষা, কবে অনিক ওকে খুলে বলবে মনের কথা,একসাথে সারাটা জীবন চলার কথা।এভাবেই কেটে যায় চারটি বছর।
২৩ জুন।অনিকের জন্মদিন।এই একটা দিন ঘিরে নৈরিতার কল্পনার শেষ নেই।নিজের জন্মদিন নিয়েও এত ভাবনা থাকে না যতটা এই দিনটাকে নিয়ে ভাবে ও। প্রতিবছরই কয়েকমাস আগে থেকেই চিন্তা এবার কি উপহার দিবে অনিককে। যাই দিক না কেন সাথে থাকে একটা ছোট্ট চিঠি,কোন খামে নয়।ছোটবেলায় যেমন কাগজ দিয়ে ফুল বানাতো,তেমনি একটা কাগজে চিঠিটা লিখে ফুল বানিয়ে দিত অনিককে।অনিকও সারা বছর অপেক্ষায় থাকত নৈরিতার দেয়া কাগজের ফুলের জন্য।
ভার্সিটি লাইফ শেষের দিকে।এবার নৈরিতাকে খুলে বলতে হবে মনের কথা,আজ অনিকের জন্মদিন।জানে আজ নৈরিতা ওকে কাগজের ফুল দিবে,আর অনিক আজ ওকে দিবে এক গুচ্ছ দোলনচাঁপা। যে দোলনচাঁপার জন্য মেয়েটা এতদিন অপেক্ষায় আছে।নৈরিতা অনেকদিন দোলনচাঁপা চেয়েছে ওর কাছে,কিন্তু অনিক কখনো দেয়নি।আজ দিবে,সাথে বলবে একান্ত কিছু কথা। বাসা থেকে বের হয়ে ফুল কিনতে শাহবাগ আসে অনিক।প্রতিদিনের অভ্যাসমত কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা পার হতে যায়।এই আরেক জঘন্য অভ্যাস ওর। এ জন্য কত যে ধমক খেয়েছে নৈরিতার। তারপরও চেঞ্জ হয় না।আর আজ তো ওর দু চোখে স্বপ্ন। হঠাৎ দেখে একটা বাস সিগন্যাল না মেনেই ওর দিকে ছুটে আসছে।তার পর মূহুর্তেই দেখতে পায় অসীম শূন্যতা।
খবরটা নৈরিতা যখন পায়,তখন সন্ধ্যা। অনিকের প্রিয় চকলেট কেক আর কাগজের ফুল নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ও।সেই সন্ধ্যার পর ওর জীবনটা হঠাৎ করেই বদলে গেল।দুজন প্রাণের বন্ধুর মধ্যে তৈরি হয় অসীমের দূরত্ব। অনেক সময় লেগেছিল ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে। সবাই বলত জীবনটা নতুন করে শুরু কর,যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে,তার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করবি নাকি?কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছিল না নৈরিতা। শেষে সব কিছুর হাত থেকে পালাতেই বিদেশে পাড়ি জমায় নৈরিতা।বাবা মাকে পড়ালেখার কথা বুঝিয়ে চলে আসে। শুরু করে নতুন জীবন। বাকি দিনগুলো কাজ,পড়াশুনা আর বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই ডুবে থাকে নৈরিতা,অনিককে ভুলে থাকার চেষ্টা করে।নিজেকে তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য।শুধু ২৩ তারিখ আসলেই উল্টাপাল্টা হয়ে যায় ওর গুছানো জীবন।সারা রাত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায়।
রাত ১২টার ঘন্টা বেজে ওঠে।আজ সেই ২৩জুন।ওর অনিকের জন্মদিন।চিঠিটা লিখা শেষ করে নৈরিতা,তারপর কাগজটা ভাঁজ করে ফুল বানাতে থাকে।নিজের অজান্তেই চোখের জলে ভিজে যায় ওর কাগজের ফুল। তারপর...শুভ জন্মদিন অনিক... চোখ বন্ধ করে ফুঁ দেয় মোমাবাতিটায়।
.........কিছুদিন আগেই সড়ক দূর্ঘটনায় জীবনটা বদলে যায় বুয়েটের একজন মেধাবী ছাত্রীর,আমার কাছের একজন বন্ধুর। তার কিছুদিন পরই শাহবাগে হারিয়ে যায় ঢাকা ভার্সিটির আরেক তরুন প্রাণ।নিজেদের সামান্য ভুলে বা বাস,গাড়ি চালকদের অবহেলায় প্রতি বছর হারিয়ে যায় প্রিয় মুখগুলো।এর যেন কোন প্রতিকারই নেই।আসুন আমরা মনে রাখি,সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।



                                                                                                                        --------ইরতিজা হক


No comments:

Post a Comment