Saturday, 15 September 2012

একটি সাধারণ প্রেমের গল্প


খাবার সামনে নিয়ে খুব অস্বস্তিতে বসে আছে ইরফান। ঈদের পরদিন বলে স্বাভাবিকভাবেই মেনুতে মিষ্টিজাতীয় খাবারের আধিক্য বেশি। সেমাই, জর্দা আর বেশ কয়েকপদের পিঠা। তবে ইরফানের অস্বস্তির কারণ খাবার না, মিষ্টি খেতে বরং ওর ভালোই লাগে…কিন্তু একটু পরে নীলাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হতে হবে বলেই কেমন জানি লাগছে…
নীলা ওর বন্ধু আকরামের ছোট বোন।

সুন্দরী, আকর্ষনীয়া এবং স্মার্ট। ছোটবেলা থেকেই ইরফান ওকে চেনে…আকরাম আর ইরফান একেবারে নেংটা বেলা থেকেই পরস্পরের বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে। এইচ,এস,সি’র পর ইরফান ইউ,এস চলে গেলেও যোগাযোগ ঠিকই ছিল…গত বছর দীর্ঘ ১২ বছর পর ইরফান ইউ,এস এর পাট চুকিয়ে দেশে এসেছে…বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে বেশ বড় একটি পদে আছে…বন্ধুবর আকরামও ইতোমধ্যে নিজ কার্যক্ষেত্রে সফল একজন মানুষ।
গতকাল রাতে হঠাৎ করেই নীলা ফোন করে জানালো যে আজ ও সারাদিন ইরফানের সাথে ঘুরতে চায়…তবে শর্ত হচ্ছে বাহন হবে রিকশা। ছোটবেলায় একবার রিকশা থেকে পড়ে যাবার পর ইরফানের ভেতরে একটা রিকশাভীতি আছে…তাছাড়া দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার কারনে সিটবেল্ট ছাড়া কোন বাহনে ওঠার কথা ও চিন্তাও করতে পারে না (বাইকে চড়া ওর কখনোই পছন্দ নয়!)। সেই রিকশায় ওকে আজ চড়তে হবে, তাও নীলার সাথে…এমনিতে ইরফান বেশ চটপটে এবং বুদ্ধিমান। কিন্তু নীলার সামনাসামনি হলে কি জানি হয়ে যায়…একটার পর একটা বোকার মতন কাজ করতে থাকে…এজন্য
নীলা প্রায়ই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
মনে মনে ইরফান উপরওয়ালাকে স্মরণ করতে লাগল…’এ যাত্রা বাঁচিয়ে দাও প্রভু…’
-’আরে ভাইয়া, আপনি তো কিছুই খান নি দেখছি…’
-’আসলে, বাসা থেকে খেয়ে এসেছি তো, তাই অল্প করে খেলাম…’
নীলা আকাশী রঙের একটি শাড়ি পড়েছে…নীলাকে দেখে ইরফানের সেই পুরনো কথাটা আবার মনে হল- ‘শাড়িতে কোন মেয়েকে যতটা সুন্দর লাগে, তা আর অন্য কোন পোশাকে সম্ভব নয়…’ নীলাকে আজ মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসা কোন অপ্সরী…কিন্তু মুখ ফুটে কিছুতেই ও সেটা বলতে পারল না…
এদিকে নীলা মনে মনে ভাবছে ‘লোকটা এত বোকা কেন!’ ওকে দেখানোর জন্যেই আজ শাড়ি পড়ল, অথচ ভদ্রতা করে একটা কথাও বলল না…শেষে নিজেই বলে উঠল,
-’ইরফান ভাইয়া, আজ আমি আপনার অনারে শাড়ি পড়েছি…’
-’তাই নাকি? থ্যাংক ইউ…’
‘থ্যাংক ইউ??? হায় রে কপাল…’ মনে মনে নীলা নিজেই নিজের মাথা চাপড়াতে লাগল…
তবে কথা বলার সময় মনের ভাব মনেই চেপে রেখে সে বলল,
-’চলুন তবে যাওয়া যাক…’
-’ঠিক আছে, চল। ভাল কথা, তুমি কি সত্যি সত্যি কি রিকশায় করে ঘুরতে চাও???’
-’কেন? আপনার কোন সমস্যা আছে নাকি? সমস্যা থাকলে থাক…’
-’না না…সমস্যার কি আছে…চল…’
ইরফানকে রিকশায় কাঁচুমাঁচু হয়ে বসে থাকতে দেখে নীলার একটু মায়াই লাগল। এক হাত দিয়ে যেভাবে রিকশার হুড ধরে আছে, দেখে মনে হচ্ছে সাঁতার না জানা কোন মানুষ যেন টিউব নিয়ে পানিতে নেমেছে…লোকটার যে রিকশাভীতি আছে এটা ও জানত- কিন্তু এতটা তা জানা ছিল না…
-’ভাইয়া, আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? হলে আমরা নেমে যাই…’
-’অনেকদিন পর উঠেছি তো, তাই একটু ভয় লাগছে…চিন্তা কর না, একটু পর ঠিক হয়ে যাবে…’
-’এক কাজ করুন, আপনি আমার হাত ধরুন-দেখবেন ভয় কেটে যাবে!’
একটু ইতস্তত করে ইরফান সত্যি সত্যি নীলার হাত ধরল…তবে অন্য হাতটা হুড থেকে সরাল না…অবাক ব্যাপার!! কিছুক্ষণ পর আসলেই ইরফানের ভয় কমে যেতে থাকল…!!! কেন জানি মনে হতে লাগল ওর কোন ভয় নেই, নীলা ওকে যে কোন ধরনের বিপস-আপদ থেকে রক্ষা করবে…
-’অদ্ভুত ব্যাপার তো! আসলেই আমার আর ভয় লাগছে না’- ইরফানের বিস্ময়ভরা স্বগতোক্তি।
-’সত্যি? যাক বাবা বাঁচলাম…আপনাকে দেখে তো আমারই ভয় লাগা শুরু হয়ে গিয়েছিল…’
-’তুমি কিভাবে জানতে যে হাত ধরলে আমার ভয় কেটে যাবে??’
-’জানতাম না, তবে এমনটি হোক- তা খুব করে চেয়েছিলাম…’
-’আশ্চর্য!!!!’
রিকশা সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নীলার আবদার, সংসদের চত্বরে বসে বাদাম খাবে। রিকশার ভাড়া দিতে দিয়ে ইরফানের মুখ শুকিয়ে গেল…’যাহ! নগদ টাকা দেখি সাথে বেশি নেই…’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,
-’এই তুমি কি কার্ড একসেপ্ট কর???’
নীলার খিলখিল হাসি শুনে ইরফানের খেয়াল হল কথাটা বোকার মতন বলে ফেলেছে ও…নীলা হাসতে হাসতে জানালো,
-’ভাইয়া, আমাদের রিকশাওয়ালারা এখনো এত হাইটেক হয় নি…দাঁড়ান, আমার কাছে ভাংতি আছে…আমি দিয়ে দিচ্ছি…’
-’ইয়ে…মানে…এত তাড়াহুড়া করে বের হয়েছি…মানিব্যাগ চেক করার সময় পাই নি…তাছাড়া নগদ টাকা আমার কাছে খুব একটা কখনোই থাকে না…’
-’ভাইয়া, ইট্‌স ওকে…এত বিব্রত হবার কিছু নেই…চলুন ঐ সিঁড়ির ওখানে বসি…’
ইরফান চুপচাপ বাদাম খাচ্ছে। এদিকে নীলা আড়চোখে ওকে দেখে বুঝলো বেচারা এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। এমন সময় আকাশে এক ঝাঁক পাখি দেখা গেল। নীলা উচ্ছ্বাসভরে বলল,
-’ভাইয়া দেখুন- কত পাখি…কি সুন্দর!!!’
-’তাই তো! মনে হয় ওরা অতিথী পাখি…শীতকাল তো প্রায় শুরু হয়ে গেছে…’
-’আমারো তাই মনে হয়। আচ্ছা ভাইয়া, বলুন তো এই যে পাখিরা এত দূরদেশ থেকে আমাদের এখানে উড়ে আসে…কেন?’
-’উম্‌ম, খাবারের জন্য…????’
-’উহু…হল না…ওরা এখানে উড়ে আসে কারণ ওরা পাখি…ওদের ডানা আছে…তা না হলে হেঁটে বা কোন বাহনে আসত…হি হি হি হি…!!!!’
-’হা হা হা হা’- ইরফান এত জোরে হেসে উঠল যে আশপাশের সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকাতে লাগল…
হাসতে হাসতে ইরফানের চোখে পানি এসে গেল। একটু পর হাসি থামলে বলল,
-’তোমার এই সেন্স অব হিউমারটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ…’
-’আর আমাকে???’
-”কি????’
-’না মানে…বলছি যে, আমাকে আপনার কেমন লাগে????’
-’তোমাকে ভাল না লাগার কি আছে??’
-’তারমানে খুব বেশি ভাল লাগে না…’
-’আরে না…আমি আসলে ঠিক করে কথাটা বলতে পারলাম না…সত্যি করে বলতে কি, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে…কিন্তু কেন জানি তুমি আশেপাশে থাকলে আমার মাথাটা কম কাজ করে…তাই খালি বোকার মতন করে ফেলি…’
-’আপনি এমনিতেও অনেক বোকা। সেদিন আমি একটা লিস্ট করলাম- বোকাদের লিস্ট…সেই লিস্টে আপনার নাম একেবারে প্রথম দিকে…দুই নম্বরে…’
- ‘দুই নম্বরে কেন??’
-’কারন, এক নম্বরে আমি নিজে আছি…আপনার মতন বোকাকে আমি পছন্দ করি- আমি এক নম্বরে থাকব না তো কে থাকবে???’
-’সত্যি????’ ইরফান অবাক হয়ে নীলার লাজুক মুখটার দিকে তাকাল…
-’সত্যি না তো কি??? কিন্তু আমার কপালটা এতটাই খারাপ…এই জিনিসটাও আমাকেই জানাতে হল…আপনি নিজে থেকে বুঝলেন না…’
আবার কি জানি কি হল, ইরফানের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
-’থ্যাংক ইউ…!!!!!!’
দীর্ঘ দশ সেকেন্ড দুই জন দুইজনের দিকে তাকিয়ে থেকে একসাথে হেসে ফেলল। শেষ বিকেলের রক্তিম আলোর পাশাপাশি দুইজনের চোখ-মুখে অন্য একধরনের ঔজ্জ্বলতা দেখা গেল। অনেক দিন ধরে খোঁজ করতে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন…উঠে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে ইরফান বলল,
-’চলো, ঘরে ফেরা যাক।’
বলার পরই একটুও ইতস্তত না করে হাতটা নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল,
-’শ্যাল উই?????’


                                                                                                                          
                                                                                                                                        ক্যাডেটকলেজ ব্লগ 

No comments:

Post a Comment