Saturday 15 September, 2012

সেই একই কাহিনী



এনাফ ইজ এনাফ.. এই ছেলেটা এমন কেন? এতো ভাব নেয় কেন সে?
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে নিধি। ওর রুমমেট কেয়া, নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফেসবুকিংএ ব্যস্ত। কিছুটা অন্যমনস্ক..

কেয়া - কি হল? কার কথা বলিস?
নিধি- কে আর! শায়ান..
কেয়া- ও শায়ান? আমাদের কবি সাহেব?
নি - কবি না ছাই।উল্টাপাল্টা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিছু একটা লিখলেই সেটা কবিতা হয়ে যায়? আর গল্প! গল্প মাশাল্লাহ সে যেগুলা লেখে, পড়ে মানুষের বদহজম হয়ে যাবে.. এতো হাই থট কপচানোর কি দরকার তার? আরে ব্যাটা সহজ সরল প্রেমের গল্প লিখ.. পাবলিক খাবে, বেশি বেশি লাইক পড়বে, তারপর ডবল ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াবি তুই ..
কে - দাঁড়া দাঁড়া তোর এফবি এক্টিভিটি তো নাই বললেই চলে, চুপিচুপি ঢুকে ওর গল্প পড়িস নাকি!

নি - ইশশ বয়েই গেছে আমার.. দুই একটা পড়েছিলাম, তাতেই যা বোঝার বুঝে গেছি।
কে - কি জানি। আমার তো ভালই লাগে শায়ানের লেখা। আর বাকি সবার সাথে তো কোন প্রবলেমও হয়না ওর। শুধু তুই রাগিস বলেই তোকে খেপিয়ে মজা পায়। তা ক্লাসমেটরা দুষ্টুমি না করলে কে করবে বল? এমনিতে শায়ান ছেলে ভাল।
নি - খবরদার! খবরদার বলছি ওর সাইড নিবিনা। ফাঁকিবাজ একটা ছেলে। কোন ক্লাস ঠিকমত করেনা। সকালের ক্লাসে যদিও বা আসে কোনদিন ঢুলতে ঢুলতে, লাস্ট বেঞ্চে পড়ে পড়ে ঘুমায়। এই তো সেদিনের কথা.. আমার পেছনের বেঞ্চে মাথা ফেলে মিহি স্বরে নাক ডাকা শুরু করল। এদিকে তো আমি লেকচারে মনই দিতে পারি না। এক লাইন শুনি তো পরের লাইন তার নাক ফুঁড়ে আসা বাঁশীর মত আওয়াজে চাপা পড়ে যায়.. উসখুস উসখুস করছি, ওকে জাগাবো কিনা ভাবছি। হঠাত্‍ দেখি ঘুমের মাঝে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে.. মানে কি বুঝলি? সব আমাকে জ্বালানোর ষড়যন্ত্র ..

চোখ বড়বড় করে বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে নালিশ করে যাচ্ছে নিধি.. কেয়া হাত ধরে পাশে বসায় ওকে, গাল টেনে দেয়..

- তাই?.. আমাদের এমন মিষ্টি মেয়েটার পেছনে ক্লাসের দুষ্টু ছেলেটা এভাবে পড়েছে আজকাল! তো তারপর তুই কি করলি?
নিধি - ইচ্ছে করছিল কান টেনে দেই গাধাটার। সেটা তো আর করতে পারিনি, নিজেই উঠে গিয়ে অন্য খানে বসেছি।
কে - আসলে কি জানিস, তোর রিএকশন দেখার জন্যই এমন করে ও..
নি - জানিনা.. কেন করে। আচ্ছা বলতো একটা মানুষের মুড এতো ভাল থাকে কিভাবে? তাও সবসময়? হা হা পার্টির প্রেসিডেন্ট যেন। সারাক্ষণ হাসছে.. ক্লাসে, ক্যান্টিনে। সারা সন্ধ্যা পড়ে আছে.. ক্যাম্পাসে, আড্ডায়। ও না
লোকাল? বাসায় যেতে পারেনা? আজও সন্ধ্যায় ক্যান্টিন থেকে ফিরছি নাস্তা করে। দেখি বসে আছে ছাত্র সংসদের ওখানে, সাথে হা হা পার্টির বাকি মেম্বাররা। কেউ কবি, কেউ গিটারিস্ট.. চা খাচ্ছে, সিগারেট ফুঁকছে। আহা কি ভাব এক একজনের। ইচ্ছে তো করে ওর ঝাঁটার মত খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলোয় একদিন আগুন ধরিয়ে দিই..
কেয়া - শোন, ব্যাপারটা হচ্ছে তোরা দুইজন জাস্ট অপোজিট। তুই টিপিক্যাল ভাল একটা মেয়ে। পড়ুয়া, নরম সরম, এই যে ভারী চশমাটা চোখে। আর ও বেচারাদিলখোলা, সংস্কৃতিমনা, ফাঁকিবাজ টাইপ ছেলে, তবে একদম যে পড়ে না তাও কিন্তু না..
নি - জানি তো.. আরে না পড়ে কেউ কখনো পাশ করে নাকি। কিন্তু লুকাবে কেন বল? পরীক্ষার দিন সকালে এসে হা হা পার্টির বাকি সবাইকে বলবে, "দোস্ত কাল সারারাত মুভি দেখলাম। আজ নির্ঘাত ফেল।" কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে এসেই আবার বলবে, "আরে জটিল পরীক্ষা দিসি রে মামু!"

হাসি চাপে কেয়া। বলে - ওকে.. এটারও ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে.. হয়তো ওর বেসিক ক্লিয়ার। তাই কম পড়েই পরীক্ষায় উতরে যায়..
নি - এ্যই দাঁড়া দাঁড়া.. তুই কার দলে.. ওর না আমার!
কে - আমি দুজনেরই দলে। দুজন দুরকম হলেও আমি জানি তোরা দুজনেই কতটা ভাল। আমি বলি কি, একটা শুভ দিন দেখে বন্ধুত্ব করে ফেল! তবে একটা কথা.. এরকম অপোজিট ক্যারেক্টারদের প্রেমে পড়ার বহু নজির আছে এ ক্যাম্পাসে.. তাই সাবধান!

বলেই পালাল কেয়া..

ওদিকে নিধি - কেয়ারে, শক্ত মাইর খাবি তুই। আমি আর ঐ কবি শায়ান.. আমরা.. মানে আমাদের মধ্যে..
কেয়া ফোঁড়ন কাটল - প্রেম.. প্রেম..
নিধি - ছিঃ ছিছিঃ ছিছিঃ.. প্রেম তো দূরের কথা। ওকে দেখলে কি কি সব ইচ্ছা হয় আমার জানিস? মনে হয় ওর চুলে চুইংগাম আটকে দেই.. কানে পিঁপড়া ঢেলে দেই.. আর ঐ মুখে আমি স্কচ টেপ মেরে দেই..

হাসছে কেয়া। উফফ নিধিটা পারেও বটে.. ক্লাসে যেভাবে ভুরু কুঁচকে চশমার উপর দিয়ে তাকায় শায়ানের দিকে.. আর শায়ানটাও.. সারাক্ষণ লেগে থাকে নিধির পেছনে। আল্লাহই জানে এদের কি হবে..

পরদিন। ক্লাসে..

নিধি - কি ব্যাপার তুই! চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলি যে? পেছনে জায়গা নাই? মেয়েদের পাশেই বসতে হয়?
শায়ান - প্রয়োজনে মানুষকে কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়! তবে আঁতেল সমাজের এমন বিশিষ্ট প্রতিনিধির পাশে বসার সুযোগ পেয়ে আমি বেশ সম্মানিত বোধ করছি!
নি - কতবার বলেছি আমাকে আঁতেল বলবিনা..
শা - ঠিক আছে। বললাম না। আপাতত.. কিন্তু ম্যাডাম, আপনার চশমাটা দেখেছেন কি অদ্ভুতভাবে ঝুলে আছে.. আঁতেলদের মত? ঠিক করেন তাড়াতাড়ি। আর সাইলেন্স প্লিজ.. এটা ক্লাস, আমি পড়া বোঝার চেষ্টা করছি!
নি - ওরে.. আসছে কোন পণ্ডিত ক্লাসে পড়া বুঝতে! কোন ক্লাস চলছে তাও তো বলতে পারবিনা..
শা - পারতাম, পাশে আপনি না থাকলে। কখন থেকে কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন!
নি - আমি.. আমি বেশী কথা বলছি..

রাগে তিড়বিড় করে জ্বলে উঠে নিধি। কি বলবে বুঝে পায়না। কতক্ষণ পর.. হঠাত্‍ খেয়াল হয় শায়ান ঘুমঘুম চোখে মোবাইল গুতাচ্ছে..

নিধি - এ্যই ছেলে এ্যই..
শায়ান - হুমম..
নি - লেকচারটা তুললে তো পারিস। আমাকে বিরক্ত করা শেষ না? তোর সামনে আসা তো সাকসেসফুল..
শা - আচ্ছা, এতো ইম্পরটেন্স কিভাবে দিস তোরা মেয়েরা নিজেদের? সামনে এসেছি কি তোকে বিরক্ত করতে! না ম্যাডাম, আমি ফ্যানের বাতাস খেতে সামনে আসছি। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতিস, পেছনের ফ্যানটা নষ্ট।

পেছন ফিরে দেখে নিধি। আসলেই তাই। একটু যেন মন খারাপ হয়ে যায়। আস্তে করে বলে-ও..

শায়ান - কি? শুনে খারাপ লাগল?
নি - আশ্চর্য তো! আমার কেন খারাপ লাগবে!
শা - তুই ই জানিস..

দুষ্টুমির হাসি দেখা যায় শায়ানের মুখে..


কিছুদিন পর। ঘটনাস্থল-লিফট

লিফটে উঠল নিধি। সাত তালায় ওদের লাইব্রেরীতে যাবে। অপেক্ষা করছিল আর কোন ছেলেমেয়ে যদি আসে। একা লিফটে উঠতে ভীষণ ভয় লাগে ওর। নাহ কেউ নেই আশেপাশে। দুষ্টু কেয়াটা কেন যে লাইব্রেরী না এসে শপিংএ চলে গেল..

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিফটের বোতাম চাপল ও, কিন্তু দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ঢুকল কেউ একজন..

শায়ান - হাই..
নিধি - তুই!
শা - হ্যাঁ আমি, এতো অবাক হবার কি আছে!
নি - আমি অবাক না.. আমার রাগ লাগছে।
শা - যাক কিছু তো একটা এক্সপ্রেশন আছে! নইলে যা করিস! ক্লাসে যন্ত্রের মত লেকচার তুলতে থাকিস, রাস্তায় রোবটের মত মেপে মেপে হাঁটিস, পরিচিতদের দেখলে মাথা আরও দুই হাত নিচে নামিয়ে ফেলিস, আর কথা বলিস ঘণ্টায় সাড়ে তিনটা করে।এ কমাত্র রাগলেই শুরু হয়ে যায় পটর পটর। আজব!
নি - আচ্ছা আমি আজব! আর তোর কাজ কারবার? ফাঁকিবাজ তকমা লাগিয়ে খুব তো ঘুরিস, তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে আবার লাইব্রেরীতেও আসা হয়..
শা - কেন? আমার গায়ে কি বোরখা পরা? লুকালামটা কোথায় সেটাই তো বুঝলাম না! আমাদের রাকিব আছে না? আমার রুমমেট। ফোন ফেলে এসেছিল বলে জাস্ট দিয়ে যেতে আসছি।
- ও..

দমে গেল নিধি। কেন বারবার হেরে যায় ও শায়ানের কাছে। আর কেনইবা ওকে দেখে এতো রাগ, ওর প্রতিটা আচরণে এতো বিরক্তি খুঁজে নেয় সে.. এতোটা ইম্পরটেন্স কেন দিচ্ছে সে এই ছেলেটাকে! বোঝেনা নিধি, কিচ্ছু বোঝেনা। সেদিন মাঝরাতে হঠাত্‍কি হল, অন্ধকারে গান শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল.. কি অদ্ভুত একটা শুন্যতা.. হাহাকার যেন, আর অচেনা অজানা একটা কষ্ট.. প্রেমের গান ছিল সেটা। অথচ আগে এসব গানে এক বিন্দু আবেগ খুঁজে পেতোনা সে। এসব হচ্ছেটা কি তার সাথে! এই শায়ানটাকেই কেন মনে হচ্ছে সব নষ্টের গোঁড়া! ওর তাকানো, হাসি, বড় বড় চোখদুটোয় নিধির ছোটখাটো কাজগুলো পর্যন্ত লক্ষ্য করা, সারাক্ষণের
খুনসুটি আর দুষ্টুমির আড়ালে যেন আরও কিছু বলে ফেলা.. রোজকার রুটিনে কোন পরিবর্তন আসেনা। শুধু বোঝে নিধি, একটু একটু করে আরও কাছে আসছে শায়ান। এখন ওর থেকে দূরে থাকা কষ্টকর, আর কাছে থাকা বিড়ম্বনা! নার্ভাসনেস এড়াতে গিয়ে উল্টাপাল্টা সব কাজ করে নিধি, আর তারপরই প্রচণ্ড প্রচণ্ড রাগ হয় নিজের উপর। সেদিনই তো.. ক্যান্টিনে হঠাত্‍ শায়ানকে ঢুকতে দেখে হাতের ধাক্কায় স্প্রাইটের বোতলটা ফেলে দিল ভুলে। কাচের বোতল.. ঝনঝন শব্দ তুলে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। পুরো ক্যান্টিন তাকিয়ে আছে তার দিকে, শায়ান তাকিয়ে আছে.. কোথায় লুকাবে ভেবে পাচ্ছিল না ও।
খোদা এ কি পেরেশানিতে ফেললে তুমি আমাকে!..

ভাবনায় ডুবে ছিল নিধি। চমকে উঠল শায়ানের কথায়..

এই রে, লিফটটা বোধয় আটকে গেছে।
নিধি - কি..! আটকে গেছে? কেন? কখন থেকে? কি হবে এখন? দম আটকে মারা যাব তো আমরা!
শা - আরে না। এই লিফটটা মাঝেমাঝে এমনিই একটু সমস্যা করে। ঠিক হয়ে যাবে। লিফট মামার নাম্বার আছে আমার কাছে। কল দিচ্ছি দাঁড়া..
নি - রাখ তোর লিফট মামা.. না জানি কোথায় না কোথায় গিয়ে বসে আছে। আসতে সময় লাগবে না বুঝি? এর মাঝে যদি লাইট বন্ধ হয়ে যায়? সাফোকেটেড লাগবে না.. আর নেটওয়ার্ক? নেটওয়ার্ক আছে তো তোর মোবাইলে?
শা - আছে রে বাবা। আর উনি আসার আগেই দেখবি ঠিক হয়ে গেছে। নিজে থেকেই গণ্ডগোল করে পরে আবার ঠিক হয়ে যায় এইটা। আর তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন!
নি - আমিতো ভীতুই, ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে আমার।
শা - সেটা আবার কি?
নি - বদ্ধ জায়গায়, অন্ধকারে ভীষণ ভয় পাই আমি। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমার তো এখনি খারাপ লাগছে.. লিফটের দেয়াল আঁকড়ে ধরে নিধি।
শা - আরে এতো ঘামছিস কেন? বেশী খারাপ লাগছে? নিধি.. এই নিধি, আমার দিকে তাকা.. দু হাতে নিধির কাঁধ আঁকড়ে ধরে শায়ান।
দেখ আমাকে। আমি তোর বন্ধু না? কত্ত স্ট্রং আমি জানিস.. কত্ত সাহস আমার! আমি থাকতে আমার বন্ধুর কিছু হয়ে যাবে আর আমি বসে বসে দেখব ভেবেছিস? কিচ্ছু হবেনা তোর, আমি বলছি। এখন আমি যা বলি শোন.. চোখ বন্ধ কর। কর বন্ধ, আর ভাবতে থাক তোর সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটার কথা। ভাব যে তুই সেখানেই আছিস। আর সব ভুলে সেখানে চলে যা তুই। দেখ তো, দেখতে পাচ্ছিস জায়গাটা?

বন্ধ চোখে বিড়বিড় করে নিধি - একটা সাগরতীর.. পায়ে এসে ভেঙে পড়া ঢেউ..

শা - আর?
নি - আর শেষ বেলা, গোধূলি.. অনেক অনেক বাতাস.. কি মুক্ত চারপাশটা.. প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়..
শা - হ্যাঁ এমনই কোথাও আছি আমরা। চোখ খুলিসনা, ভেবে যা শুধু.. চারদিক খোলামেলা, বদ্ধ কিছু নেই। কিচ্ছু হবেনা তোর। আমি আছিতো সাথে..

চট করে চোখটা খুলল নিধি। তাকাল শায়ানের চোখে। সেখানে স্বপ্ন একরাশ.. মুক্তির.. আনন্দের.. প্রতি নিঃশ্বাসে বাঁচার সুখ। নিধির মনে হল এ পৃথিবীতে খারাপ কিচ্ছু নেই। ঘটতেই পারেনা। শুধু কেউ একজন পাশে থাকা চাই..

টুং করে একটা শব্দ হল। খুলে গেছে লিফটের দরজা। হাসল শায়ান,

- দেখলি, সব ঠিক হয়ে গেছে।
- হুমম.. যেন বহুদূরের কোন রূপকথার জগত থেকে বাস্তবে ফিরল নিধি। শায়ান কি বলছে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। শুধু চাইছে আরও কিছুটা সময় কাছে থাকুক সে.. আরেকটু সময়..

তারও কিছুদিন পর..

বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে হোস্টেলে ফিরল নিধি।ধাম করে ব্যাগটা রাখল টেবিলের উপর। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। পরীক্ষা শেষ করে বাইরে আসার পর নিজের অজান্তেই ওর চোখদুটো বারবার খুঁজছিল শায়ানকে আজ। আর তখনি দেখল.. শায়ানকে, ওদের ক্লাস সুন্দরী রূমকীর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ওর প্রতিটা কথায় হাসতে হাসতে অলমোস্ট ওর গায়ে পড়ে যাচ্ছিল রূমকী। দেখে মাথায় আগুন ধরে যায় নিধির। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে ওখান থেকে। শায়ান পিছু ডাকছিল

"এইযে ম্যাডাম, এতক্ষণ ধরে কি পরীক্ষা দিলেন? এই নিধি.."

ওর কথার কোন উত্তর না দিয়েই চলে এলো। নিজের উপর মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছে ওর এখন "কি দরকার ছিল নিধি তোমার এতো স্বপ্ন দেখার? সবকিছু সবার জন্য হয়না.."

কিরে, একা একা কি এতো বিড়বিড় করিস? - রুমে ঢুকল কেয়া।
নিধি - নাহ কিচ্ছু না।
কে - আচ্ছা তন্বী বলছিল বাইরে খেতে যাবে সন্ধ্যায়, আমরা কেউ যাব কিনা। আমি না করে দিয়েছি।
নি - না আমি যাব।
কে - কিন্তু তুই তো সন্ধ্যায় বড়জোর ক্যান্টিন পর্যন্ত যাস। আর আজ ওয়েদারও খুব একটা ভালনা।
নি - না আমি যাব। কোথা থেকে ঘুরে আসলে হয়তো মনটা একটু শান্ত হবে।
কে - কেন অশান্ত হবার মত কি হল আবার?
নি - হয়েছে। আচ্ছা আমি পরে বলব তোকে।

নিধির মাথায় ঝড় চলছে.. আসলেই তো, কেন মনে হল তার যে শায়ান তাকে পছন্দ করে! কি দেখে মনে হল! ও তো সবার সাথেই একইরকম। ঠাট্টা ফাজলামি তো ওর স্বভাব। রূমকি যা নিধিও তা। আরে ফ্লার্টিং তো স্টাইল আজকালকার। আর নিধির মত বোকাবোকা, আঁতেল টাইপ মেয়েদের পেছনে লেগেই বোধয় ছেলেরা একটু বেশী মজা পায়। হোস্টেলে গিয়ে সবাই মিলে হয়তো কত হাসে ওকে নিয়ে। আর সে!

এতো সহজে বদলে গেল! ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে এখন শুধু একটা নামের আধিপত্য। মাঝেমাঝে তো দুঃসাহসী হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। বলতে ইচ্ছা করে "জানিস তোর অগোছালো ভাবটাই কত সুন্দর, ক্লিন শেভে স্রেফ হাঁদারাম লাগে তোকে.." বলতে ইচ্ছা করে "তোকে এড়িয়ে যাওয়া শুধু মিছে অভিনয় আমার। তীব্র কষ্ট হয় তোকে ফেলে সামনে চলে যেতে। আর তুই চলে গেলে, তাকিয়ে থাকি তৃষ্ণার্তের মত। ভাবি আবার কবে দেখা হবে! শুধু বলা হয়না, সামনে পিছনে না, আমি তো তোর পাশে হেঁটে যেতে চাই.. আড়ালে লুকানো চাহনি ফেলে অধিকার নিয়ে দেখতে চাই তোকে, একবার শুধু একবার.."

এই ভাবনাগুলো যদি মুছে ফেলতে পারতো! ভুলে যেতে পারতো কখনো এমনটা চেয়েছিল সে, রাত জেগে স্বপ্ন এঁকেছিল কারো হাত ধরবার। ছিঃ নিধি, এসব তোমার জন্যে না.. হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে নিধি।

রাত ৯টা। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে নিধি আর তন্বী। বেশ দেরী হয়ে গেছে আজ। নইলে এমন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কখনো এতো রাত পর্যন্ত হোস্টেলের বাইরে থাকেনা ওরা। আসলে রাস্তার এক জায়গায় অনেক পানি জমে গেছিল বলে রিক্সা ঘোরাতে হল, পরে আবার রিক্সার চেইন পড়ে গেল। এসে কোনভাবে খেয়ে নিয়েই বেড়িয়ে
পড়েছে ওরা। কিন্তু প্রায় আধাঘণ্টা হয়ে গেছে একটা রিক্সাও পাচ্ছেনা। বৃষ্টি টুপটাপ, সাথে পুরো শহরে লোডশেডিং।

হঠাত্‍ তন্বী বলে উঠে ফিসফিস করে - দেখছিস ছেলেগুলোকে?
নিধি - হ্যাঁ? কোথায়?
- ঐ যে, রেস্টুরেন্টেই বসে ছিল আমাদের পেছনে। দুই টেবিল জুড়ে ছয়টা ছেলে। বারবার তাকাচ্ছিল, আর এখন আমরা বেরুতেই বেড়িয়ে পড়ল। ওদের তো বাইক আছে, চলে যেতে পারতো। কিন্তু না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রিক্সার জন্য, ওরাও যাচ্ছে না।
নি - আরে ধ্যুত, ওরা ওদের মত আছে।
ত - ভাল করে দেখ নিধি, সন্দেহ করছিনা। আমি শিওর..

আড়চোখে তাকাল নিধি। এক একটাকে পুরাদস্তুর ঝানু মাস্তানের মত লাগছে..

তন্বী - নিধি শোন, আমরা একা না যাই। এমনিই সামনের রাস্তাটা নির্জন। তার উপর বৃষ্টি, অন্ধকার..

চুপ করে ভাবল নিধি। নাহ ব্যাপারটা আসলেই সিরিয়াস।

বলল - কিন্তু আর কেউতো নেই সাথে। দুজনকেই তো যেতে হবে।
ত - এক কাজ করি, ক্লাসের কাউকে ফোন দেই।
নি - কাকে?
ত - লোকাল কাউকে। ব্যাচের সবাই তো আর হোস্টেলে থাকেনা। ইয়েস.. শায়ানকে আসতে বলি।
নিধি - না না..
তন্বী - না না কিসের! এখান থেকে ওর বাসাই সবচেয়ে কাছে হবে। আর ওর পরিচিতও অনেক আছে। বলি কাউকে নিয়ে আসতে।

কি আর বলবে নিধি। মাত্র তো ভুলতে চাইছিল শায়ানকে। এখনই আবার এসে পড়বে আপদটা! তবে হ্যাঁ, আজ সিচুয়েশন এমন যে রিস্ক নেয়া ঠিক না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসল শায়ান। সাথে ওর বন্ধু কেউ।

তন্বী - আরে তোরা মাত্র দুজন!
শা - হাহ.. এদের সামলাতে আমি একাই যথেষ্ট! তাও তো কাউকে নিয়ে আসছি।
নিধি - হুমম বাংলা সিনেমার হিরো আসছেন। উনার এক ঘুষিতে সবাই এক একদিকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকবে!
শা - হ্যাঁ পড়বেই তো। আর তোরা যে বেআক্কেলের মত কাজটা করলি। এই ঝুম বৃষ্টি আর ঘুটঘুটে অন্ধকারে কেউ বাইরে খেতে আসে?
নি - আমরা যখন বেড়িয়েছিলাম তখন এতো বৃষ্টি ছিলনা, কারেন্টও ছিল। আর তোদের এতো পচা শহর, একটু বৃষ্টিতেই পানি জমে রাস্তা ব্লক হয়ে যায়। রিকশা ঘোরাও, হাজারটা ঝামেলা। আমরা কি করব?
শা - কি! আমাদের পচা শহর!
নি - জী। দুইটা মেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে শান্তি মত খেতেও পারেনা এখানে।
শা - আর আসলাম যে তোদের বাঁচাতে?
নি - হ্যাঁ হ্যাঁ এসে উদ্ধার করে ফেলেছিস!
তন্বী - আরে থাম থাম, তোদের বিখ্যাত ঝগড়া তুলে রাখ এখন। আচ্ছা শায়ান, ছেলে গুলোকে চিনিস তুই?
শা - হ্যাঁ.. পাতি গুণ্ডা সবগুলা। আসল গুণ্ডাকে তো আমি সাথে নিয়ে আসছি, ওদের বাপ!
ত - কে? ঐ যে ধনুষ্টংকারের রোগীটা? প্যাকাটির মত..
নি - দূর থেকে সুপারি গাছের মত লাগছে..
শা - আরে আস্তে বল তোরা। জানিস উনি কে! উনি হচ্ছেন বিখ্যাত গুণ্ডা "চামড়া ছিলা সোলায়মান"।
ত - ওরে বাবা..নামের কি বাহার!
শা - আরে চামড়া ছিলে সাইজ করে ফেলে সবাইকে। উনাকে দেখেই ভয় পেয়ে গেছে এরা। পিছু নেবেনা দেখিস.. এখন চল, দেরী করিসনা। বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে রিকশাও পাওয়া যাবেনা। বাইকে করে সোজা হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আসব। ছাতা আছেনা তোদের কাছে?
তন্বী - আছে আছে। কোনমতে হোস্টেলে পৌঁছতে পারলেই বাঁচি। আর আমি কিন্তু সোলায়মান ভাইয়ার সাথেই যাব। তুই নিধিকে নিয়ে যা।
নি - তন্বী.. চোখ কটমট করে তাকাল নিধি ওর দিকে।
ত - কিরে ভাই, আমি ভয় বেশী পাই জানিসনা তুই? সোলায়মান ভাইকে ছাড়া এক পাও নড়বনা আমি এখন!
শা - চলেন ম্যাডাম। খেয়ে ফেলবনা আমি আপনাকে.. শায়ান বলল। আড় চোখ দিয়ে তন্বীকে অলমোস্ট ভস্ম করে দিয়ে শায়ানের পেছনে বাইকে উঠে বসল নিধি। বাম হাতে ছাতা ধরে ডান হাতটা কোথায় রাখবে ভেবে পেলোনা কিছুতেই।
শায়ান - এই যে.. একটু ভাল করে বসেন। অন্ধকার রাস্তা, ভাঙাচোরা প্রচুর। পথে আপনাকে কোথাও ফেলে চলে গেলে তো আর রক্ষা থাকবেনা!

আলতো করে ডান হাতটা রাখে ও শায়ানের কাঁধে। ছুটে চলে বাইক... এই অন্ধকার, ফাঁকা রাস্তা, চোখে মুখে এসে পড়া বৃষ্টির ছাঁট, পাগলা হাওয়ায় উড়ে যাওয়া চুল.. ওড়না, পিছনে ফেলে আসা পাতি গুন্ডারা আর সামনের বাইকে বিখ্যাত চামড়া ছিলা সোলায়মান! সবকিছু কেমন স্বপ্নের মত লাগে নিধির। এতো কাছে ও
শায়ানের.. জীবনটা যদি এখানেই থেমে যেত..

শায়ান - নিধি..
নি - হু..
শা - আজকে এতো ডাকলাম তোকে পেছন খেকে। শুনলিনা যে?
নি - তাতে কি কোন অসুবিধা হয়েছে? রূমকী ছিল না তোর সাথে? হাহা হিহি করতে, তোর সব কথায় মুগ্ধ হতে?
শা - মানে! হ্যাঁ.. ও তোর মত বোরিং না অবশ্য! তোর মত আমাকে এতো জ্বালায় না, তোর আঁতেল গিরি..
নি - বাইক থামা।
শা - কি হল, আঁতেল বলেছি? সরি সরি আর বলবনা..
নি - শায়ান, বাইক থামা।

শায়ানের হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে যায় নিধি। ফাঁকা রাস্তায়, বৃষ্টির মধ্যে..

শা - এই নিধি কোথায় যাচ্ছিস তুই। বৃষ্টি বেড়ে গেছে তো। আরে বাবা ছাতাটা নিয়ে যা.. আচ্ছা ঠিক আছে আমার সাথে যেতে হবেনা। আমি একটা রিকশা ধরে দিচ্ছি.. নিধি..

দৌড়ে এসে ওর হাতটা ধরে শায়ান।

নিধি - খবরদার আমার হাত ধরবিনা। আমি কতটা খারাপ তুই জানিস? বন্ধুত্ব বুঝিনা, তোদের মত মডার্ন না, সেই আদ্যিকালে পড়ে আছি.. আমি জানি তুই অনেক ভাল, ফ্রেন্ডলি। সবার সাথে একই থাকিস। কিন্তু আমি যে তোকে অনেক আগেই আলাদা করে ফেলেছিলাম রে! তোর প্রতিটা কথায় রাগ দেখাতাম শুধু তোকে দূরে রাখার
জন্য। তবু এভাবেই কখন যেন তোর খুব কাছে চলে এলাম। নিজেকে ভাবতে লাগলাম তোর স্পেশাল কেউ। তোর চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছিলাম শায়ান.. সত্যি দেখেছিলাম। তাইতো আর সব কিছু মিথ্যা মনে হতো। আজ বুঝলাম কত বড় পাগল ছিলাম আমি!
শা - হয়েছে? কথা শেষ?.. কতবার বললাম তোকে ছাতার নিচে আসতে?

এক টানে ওকে কাছে নিয়ে আসে শায়ান। তারপর নিধির বিস্ময়ে বড় হয়ে যাওয়া চোখে চোখ রেখে বলে..

- আঁতেল যে আঁতেলই থেকে গেলি। সারা বছর মোটা মোটা বই পড়ে এসব মিনিংলেস লেকচার ঝাড়িস। এখন আমারটা শোন.. ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, টু দ্যা পয়েন্ট আনসার!

বলে নিধির হাতটা রাখল শায়ান ওর বুকের মাঝখানটায়।

শায়ান - শুনতে পাচ্ছিস?
নিধি - কি..
শা - এর কথা..
নি - শুধু ধুকপুক ধুকপুক..
শা - হুমম.. তুই কাছে আসলে একটু বেশীই বকবক করে এই ব্যাটা! আর সারাক্ষণ শুধু একটাই কথা..
নিধি - কোন কথাটা?
শায়ান - আই লাভ ইউ..

কতক্ষণ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাত্‍ শক্ত করে শায়ানকে জড়িয়ে ধরে নিধি.. ওকে ধরতে গিয়ে ছাতা ফেলে দেয় শায়ান!

বৃষ্টিরা দেখে ওদের, অবাক হয়ে..

আর ক্যাম্পাসের ইতিহাসে যুক্ত হয় আরও দুটো অপজিট ক্যারেক্টারের এক হওয়ার গল্প।

ঘুরে ফিরে সেই একই কাহিনী!

- রাহনুমা কুমকুম







No comments:

Post a Comment